প্রকাশিত: Sat, Feb 4, 2023 4:01 PM
আপডেট: Fri, Jun 27, 2025 7:14 PM

নুহাশ পল্লী এবং আমার হুমায়ূন আহমেদ আবিষ্কার

রফি হক  : ডিসেম্বরে আমাদের স্কুল-কলেজের বন্ধু-সহপাঠীদের মিলনমেলা ছিলো গাজীপুরের শালদাহ রিসোর্টে। এত সুন্দর একটি রিসোর্ট আছে ঢাকার অদূরে আমার জানা ছিল না। আমি ঢাকার আশে-পাশে নামকরা অধিকাংশ রিসোর্টে গিয়েছি, কিন্তু শালদাহে এই প্রথম। আমাদেরই সহপাঠী বন্ধুদের একজন এই রিসোর্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বন্ধুদের সম্মিলন নিয়ে অন্যসময়ে কিছু লিখব। এখন হুমায়ূন আহমেদের নুহাশ পল্লীর কথা সামান্য লিখি।

হুমায়ূন আহমেদের নুহাশ পল্লীর কথা এত শুনেছি, পড়েছি নানা জনের লেখায়। হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম প্রকাশক অন্যপ্রকাশের কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম ভাইয়ের লেখায় নুহাশ পল্লীর কথা আদ্যপান্ত পড়েছি। মাজারুল ভাই অত্যন্ত সুন্দর ও মনোরমভাবে সে-সবের বর্ণনা করেছেন। হুমায়ূন স্যার মাজহারুল ভাইয়ের বিয়ের পরে পরেই তাঁদের সংবর্ধনা দিয়েছিলেন এক প্রবল বর্ষণের দিনে নুহাশ পল্লীতে এবং বৃষ্টিবিলাস বাড়িতে তাঁদের বাসর যাপনের ব্যবস্থা করেছিলেন।...মুগ্ধ হয়ে সে-বর্ণনা পড়েছিলাম। মাজহারুল ভাই যে নুহাশ পল্লী এবং মেলাবছর আগে যখনকার নুহাশ পল্লীর কথা লিখেছেন তখনকার নুহাশ পল্লী অতি দুর্গমের পথ ছিল। বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কাদা-মাটি-প্যাকের রাস্তা ছিল। মাযহারুল ভাইয়েরা গিয়েছিলেন সম্ভবত হোতাপাড়া থেকে নৌকায় করে নুহাশপল্লীতে। তাঁর স্মৃতিকথায় এমনটি পড়েছিলাম ।

এছাড়াও আমার অনুজ বন্ধু প্রতিভাবান শিল্পী কারু তিতাস, খ্যাতিমান সাংবাদিক জ. ই. মামুন ও হুমায়ূন স্যারের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে দেখি একই ফ্রেমের ছবিতে নুহাশ পল্লীর অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপের ভিতর। ওদের ছবিতে এত সবুজ, এত মনোরম, এত স্নিগ্ধ নুহাশ পল্লীর রূপ দেখতাম যে আমার খুব ইচ্ছে হতো একবার অন্তত নুহাশ পল্লীতে যাবো। এদেশের দেশবরেণ্য প্রিয় একজন লেখকের হাতে তৈরি নুহাশ পল্লী দেখবো না, তা কী হয়! ভেবেছি, জ. ই. মামুন ভাই বা কারু তিতাসকে বলবো, একবার আমাকে নিয়ে যেও। আমার মৃত্যুভয় অন্যদের তুলনায় বোধহয় বেশিই। তাই যতবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতাম ততবার পরমেশ্বরের কাছে কায়মনে প্রার্থনা করতাম, আর সুস্থ হলে কী কী করবো, কোথায় কোথায় যেতে হবে তেমন একটি তালিকা তৈরি করতাম, এই তালিকাতে  নুহাশ পল্লী ভ্রমণের ইচ্ছের কথা থাকতো।...অদ্ভুত না?

হুমায়ূন আহমেদের লেখা আমি ভূতগ্রস্থের পড়েছি অনেক কম বয়সে। ঊনিশ শো ছিয়াত্তর বা সাতাত্তর সালে বা আরো আগে। তখন স্কুলে পড়ি। এর আগে থেকে আমার বই পড়ার নেশা। কিন্তু ‘নন্দিত নরকে’ পড়তে পড়তে মনে হলো এমন লেখা এর আগে পড়িনি যেখানে সব আমার এবং আমার পরিবারের কথা লেখা আছে। কিন্তু এরপর তাঁর লেখা ‘শঙ্খনীল কারাগারে’ পড়ে্িছলাম। এরপর বিচিত্রার কোনো ঈদ সংখ্যায় পড়েছিলাম, ‘অচিনপুর’। এরপর বেশ অনেকগুলো বছর আর পড়িনি, তাঁর কোনো লেখা ।

হুমায়ূন আহমেদের ‘অচিনপুর’ লেখা পড়েছিলাম মেহেরপুরের এক নিভৃত সুনসান গ্রামে। আমার বড় আপার বিয়ে, ঊনিশ শো চুয়াত্তর সালে। আপা-দুলাভাইয়ের বাড়িতে যেতাম স্কুল ছুটির সময়। ওই সুনসান ঘু-ঘু ডাকা, কোকিল ডাকা গ্রামে মাত্র কয়েকটি পরিবার থাকত। আমার দুলাভাই, সরকারি চাকরি করতেন ঢাকাতে। তিনি একজন সংস্কৃতি-জন ছিলেন। তিনি সখের নাটক করতেন সেই আমলে ঢাকার বিখ্যাত ওয়াপদা মিলনায়তনে। তিনি পড়তেন প্রচুর। তাঁর আলমারি ভর্তি বই।... তো আপার বাড়ি গেলে আমি দিনরাত পড়তাম। আমি মেহেরপুরে যেতামই বোধহয় পড়ার নেশায়। আর ওই গ্রামটির নেশায়। যে গ্রামে শুধু আমবাগান আর আমবাগান। গাছ আর গাছ। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মেঠোপথ। একটি বাড়ির থেকে আরেকটি বাড়ির দূরত্ব ন্যূনতম তিন শো মিটার। অপূর্ব। এমন সুনসান প্রায় জনমানুষ্যিহীন গ্রাম আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। বহু বহু পরে, সম্ভবত ছিয়াশি বা সাতাশি সালে আমার এক বিশেষ বান্ধবী আমাকে হুমায়ূন স্যারের ‘কোথাও কেউ নেই’ তিন খণ্ডের বইটি আমায় উপহার দিয়েছিল। তখনও তাঁর ওই বিখ্যাত ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকটি তৈরি হয়নি ।

আমার ভেতরে হুমায়ূন আহমেদ এভাবেই ঢুকেছিল। কী গভীর ভালোবাসা তাঁর জন্যে। আমি কোনো দিন ঢাকা আসব, ভাবিনি। আমি কোনো দিন আর্ট কলেজে পড়ব, ভাবিনি। আমি কোনো দিন শিল্পী হবো, ভাবিনি। ঊনিশ শো তিরাশি সালের বইমেলায় আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বইমেলার একটি স্টলে। ওই একবারই। তখন বইমেলা অত ভিড় হতো না। আর দুপুরের পরে পরে গিয়েছিলাম বলে একরকম ফাঁকা ছিল বইমেলা। মেলা প্রাঙ্গণের একাডেমীর পুকুরের দক্ষিণের কোণায় একটা খুব ছিমছাম চাটাই ঘেরা স্টলে লক্ষ করলাম, কবি নির্মলেন্দু গুণের মতো কেউ একজন বসে আছেন। গুণ আমার খুব প্রিয় কবি তখন। তাঁর ‘হুলিয়া’ কবিতাটি প্রতিদিন মুখস্থ কয়েকবার পাঠ করি। আমার ক্যাম্বিসের ব্যাগে ছিলো নীলক্ষেত ফুটপাতে পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা নির্মলেন্দু গুণের ‘হিমাংশের রক্ত চাই’। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সংস্করণের লাল প্রচ্ছদওয়ালা ‘নন্দিত নরকে’। দুটোই পট্টি লাগানো বই। আর চিত্রভাণু মজমদারের আর্টের ক্যাটালগ, নীরোদ মজমদারের ‘পুনশ্চ প্যারী’। সেদিনই কিনেছিলাম । 

‘হিমাংশুর রক্ত চাই’ -এর ব্যাক কভারে ছিল কবির ছবি । আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি তিনি কবি নির্মলেন্দু গুণ কি-না। তিনি বললেন, হ্যাঁ, এসো বাবু। খুব মোলায়েম কণ্ঠে বলেছিলেন। তাঁর সম্মতি নিয়ে স্টলে ঢুকি। তাঁর পাশে বালক চেহারার একটি লোক বসা। পুরো স্টলে এই দুজন। আর্ট কলেজের ছাত্র পরিচয় দিয়ে আমি আমার ক্যাম্বিসের ব্যাগ থেকে হিমাংশুর রক্ত চাই বইটি বাড়িয়ে দিয়ে কবিকে বইতে কিছু লিখতে অনুরোধ করি। কবি তখন পাশের লোকটিকে ইংগিত করে আমাকে বললেন, ওনাকে চিনেন? আমি বলি, না। কবি বললেন, উনি হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদ? বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। তিনি  তখনও জনপ্রিয় হননি। তখনো তাঁর তৃতীয় বই প্রকাশিত হয়নি!  

আমি উনাকে ও কবিকে আরো অবাক করে দিয়ে আমার ক্যাম্বিসের ব্যাগ থেকে ‘নন্দিত নরকে’ বইটি বের করে দিলাম। উনি সত্যি বিস্মিত হলেন। আমাকে বললেন, এ বই কোথায় পেলেন? এটা আমার প্রথম সংস্করণের বই।...আপনি আমাকে বইটি দিবেন? অখুশি হবেন না তো।...কিন্তু তিনি বইটি নেননি। তিনি বইয়ে সুন্দর করে তাঁর সুন্দর হাতের লেখায় অটোগ্রাফ দিলেন। নির্মলেন্দু গুণের হাতের লেখাও ভীষণ সুন্দর। এর পরে এই ঢাকা শহরে এতকাল বাস করলাম। আর কোনো দিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। এমনকি কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গেও আর কথা হয়নি। আমিও যাইনি। 

তবে আমার জীবনের কোনো একটি রাতে আমি হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে কথা বলবো বলে সারা রাত কেঁদে কেঁদে তাঁর ফোন নং চেয়েছিলাম টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অপারেটরদের কাছে। সে রাতে তাঁর উপন্যাস ‘নক্ষত্রের রাত’ পরে কেঁদেছিলাম। মনে হয়েছিল তিনি আমার কথাগুলো লিখেছেন। এ-রকমের কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলাম জীবনে ওই একবারই। সে-রাতে আমার তাঁর সঙ্গে অনেক কথা ছিলো- এমনটি মনে হয়েছিল। কিন্তু কোনো অপারেটর তাঁর ফোন নং আমাকে দেয়নি। আমার মনে হয়েছিল অপারেটরেরা হৃদয়হীন আর হৃদয়হীনা। মানুষের জীবন খুব রহস্যময়।

অনেক কথা বলে ফেললাম। আমি আমার পরিবার এবং আমার স্কুলের বন্ধু ইকবাল ও ইকবালের পরিবার শালদাহ থেকে ফেরার পথে আমরা গিয়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদের নুহাশ পল্লীতে। আমি কখনও যাইনি আগে, লিখেছি সে-কথা। গিয়ে মনে হলো এখানে তো এসেছি আগে, বহুবার। সন্ধ্যা হয় হয় সময়েই পৌঁছেছিলাম। তাঁর সমাধির সমুখে দাঁড়িয়ে আমি আর আমার মেয়ে রূপকথা প্রার্থনা করেছি। আমার ‘হিমু’ পাগল মেয়ের চোখে ছলছল করছে। ও বিস্ময় নিয়ে পুরো নুহাশ পল্লীকে স্পর্শ করেছে। পল্লীর  প্রতিটি গাছকে ছুঁয়ে দেখছে, যদি তার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের আঙুলের স্পর্শ পেয়ে যায় কোথাও!

নুহাশ পল্লীর একদম উত্তরে যে বড় পুকুর, নাম ‘লীলাবতী’। শুনেছি, লীলাবতী নামকরণটি হয়েছে শাওন ও তার অকালপ্রয়াত কন্যার নামে, যে পৃথিবীর আলো দেখার পূর্বেই পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছে। পুকুরে একটি কাঠের পুল রয়েছে। পুকুরের মাঝখানে একটি কৃত্রিম দ্বীপ, যেখানে তাবু পোঁতা আছে। কে জানে? সন্ধ্যার অন্ধকার পর্যন্ত আমরা পুকুর শান বাঁধানো সিঁড়িতে বসেছিলাম। আমি বারবার পুকুর ঘাটের একদম নীচের সিঁড়ি আর স্থির জলের দিকে তাকাচ্ছিলাম, মনে হলো, আমার আরেক প্রিয় লেখক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর হুমায়ূন আহমেদ স্নান করতে নেমেছেন। এমন একটা ছবি দেখেছিলাম নিউজপেপারে। সেই ছবিটিই চোখে ভাসছিলো। রূপকথা বললো, বাবা, আজ ফুল মুন। ইকবাল বললো, চলো... রাত হচ্ছে, ফিরতে হবে।

 লেখক: চিত্রশিল্পী। সোমাবার : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩। ১৬ মাঘ ১৮২৯। ফেসবুক থেকে